Menu

ইতালির শ্রমবাজারে কর্মী কম: কারণ ও প্রতিকার

শ্রমবাজার হিসেবে ইউরোপের দেশ ইতালির চাহিদা ব্যাপক। প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি স্বপ্ন দেখে ইতালিতে পাড়ি জমানোর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইতালিতে কর্মী পাঠানোর হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। যেখানে ২০২৩ সালে বৈধ পথে ১৬ হাজার ৮৭৯ জন কর্মী ইতালিতে গিয়েছিলেন, সেখানে ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে এই সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ২৪৬ জন। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।


কর্মী কমে যাওয়ার কারণ

ইতালিতে কর্মী পাঠানোর হার কমে যাওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ দেখা যাচ্ছে:

  • ভাষা ও কারিগরি জ্ঞানের অভাব: যারা ইতালিতে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেরই ইতালীয় ভাষার জ্ঞান নেই। কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতাও অনেকের নেই। ফলে সেখানে গিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রবাসী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক শাহ মো. তাইফুর রহমান বলেন, “ইতালিতে এসে ৮০ শতাংশ কর্মী বৈধ হন না। ভাষা জানেন না, কাজ জানেন না। যাঁরা ইতালির ভাষা শেখেন, তাঁরা সহজেই ভিসা পাচ্ছেন। তাই দক্ষতা ও ভাষা শেখার প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী পাঠাতে হবে।”
  • ভুয়া নিয়োগপত্র ও ভিসায় কড়াকড়ি: কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া নিয়োগপত্রের অভিযোগ ওঠায় ইতালি সরকার ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এর ফলে ভিসা প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘ সময় লাগছে এবং অনেক কর্মী ভিসা ছাড়াই পাসপোর্ট ফেরত পাচ্ছেন। শাহজাদা নামের একজন কর্মী জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগপত্র পাওয়ার পরও জুলাইয়ে ভিসা আবেদনের পর ডিসেম্বরে ভিসা ছাড়াই তার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়েছে।
  • দীর্ঘসূত্রিতা ও দূতাবাস জটিলতা: ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাস ভিসা প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাইয়ে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। এতে কর্মীদের এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন পাসপোর্ট আটকে থাকার পর অনেককে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়েছে, যা কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

অবৈধ পথে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি

বৈধ পথে ইতালিতে যাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন যে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে ইতালি প্রবেশের প্রবণতা বাড়তে পারে। এটি একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্যও ক্ষতিকর।


সমাধানের উপায়

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

  • দক্ষতা ও ভাষা শিক্ষা: কর্মীদের ইতালিতে পাঠানোর আগে ইতালীয় ভাষা এবং প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা। ইতালিতে অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার হয় না, তাই ভাষা জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি।
  • দ্বিপক্ষীয় আলোচনা: বাংলাদেশ সরকার ও ইতালি সরকারের মধ্যে ভিসা জটিলতা নিরসনে দ্রুত আলোচনা করা উচিত, যাতে ভিসার আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়।
  • পথনকশা তৈরি: রিক্রুটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ফর ইউরোপ অ্যান্ড ডেভেলপড কান্ট্রিজের সভাপতি আরিফুর রহমান ইউরোপের সব দেশে কর্মী পাঠানোর জন্য একটি পথনকশা তৈরির প্রস্তাব করেছেন। এর মাধ্যমে ভাষা ও কারিগরি জ্ঞানের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করা যেতে পারে।
  • নিয়োগকর্তা যাচাই: দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের মাধ্যমে ভালো নিয়োগকর্তা খুঁজে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
  • নতুন সমঝোতা স্মারক: সম্প্রতি ৬ মে, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে মাইগ্রেশন ও মোবিলিটি বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বৈধ পথে অভিবাসন বৃদ্ধি এবং কর্মীদের নিরাপদ ও সম্মানজনক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রকল্প

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রকল্প চালু হয়েছে, যা ইউরোপের শ্রমবাজারে বৈধ পথে দক্ষ কর্মী সরবরাহে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটি তিন বছরে (২০২৪-২৭) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এটি নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

ইতালির মতো সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে শুধু কর্মী পাঠানোই নয়, বরং দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষার প্রশিক্ষণ এবং দূতাবাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে একদিকে যেমন কর্মীরা লাভবান হবেন, তেমনি দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

world travels

owner
View All Articles